- 01 January, 2024
- 0 Comment(s)
- 494 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের নানান ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা দেখা যায়। আমরা জানি, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলিতেও নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। ইসলাম ধর্মও বৈষম্যমূলক। নারীদের ছলে-বলে-কৌশলে, লাঞ্ছনায়, সতী-অসতীর মোড়কে, পর্দাপ্রথার বাঁধনে, দোজখের আগুনে; প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে কাজে লাগিয়ে অষ্টেপৃষ্ঠে শৃঙ্খলা বদ্ধ করে জটিল থেকে জটিলতর এক পর্যায়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি মনোযোগ দিয়ে দেখি, তবে এই ধর্মীয় বিধানে নিষেধাজ্ঞা, পর্দা প্রথা, সম্পত্তির বণ্টন, বিয়ে, তালাকের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য চোখে পড়ে। বিস্তারিত আলোচনা করে আমরা এই বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করবো। আলোচনার শুরুতেই একটি কথা পরিষ্কার করে নিতে চাই, আলোচ্য প্রবন্ধে যে সকল প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হবে, সে সকল বিষয়ে কতটা বৈষম্য ছড়িয়ে আছে সেটি দেখাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য! কোন ভাবেই নির্দিষ্ট কোন ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করার জন্য এই আলোচনা নয়।
হিজাব
আতেফেহ রাজাবি সাহলেহ ইরানের নেকা শহরের ষোড়শী ছিলেন। একান্ন বছর বয়সী আলী দারবারী তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করেছিলেন। বাধ্য হয়ে আতেফেহ রাজাবি সাহালেহ আইনের দারস্থ হয়েছিলেন। যেহেতু তার সতীত্ব চলে গিয়েছিল, সেই অপরাধের জন্য তাকেই ইরানের পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আতেফেহের পরিবারের অজান্তেই আলী দারাবি তিন বছর ধরে তাকে ধর্ষণ করেছিল। কারাগারে থাকাকালীনও তাকে নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হয়। তার দাদী যখন তাকে দেখতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি দেখেন আতেফেহ ব্যথার কারণে চার হাত-পা দিয়ে চলাফেরা করছেন। তার বিচারক ছিলেন হাজী রেজাই। বিচার চলাকালীন আতেফাহ যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি তার মামলায় হেরে যাচ্ছেন, তখন তিনি রাগে, দুঃখে তার হিজাব সরিয়ে ফেলেন, ইরানে হিজাব সরিয়ে ফেলাকে চূড়ান্ত অন্যায় হিসাবে দেখা হয়। আতেফেহ রেগে গিয়ে বিচারকের দিকে জুতো ছুড়ে পারেন। এই অপরাধের কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৫ আগস্ট, ২০০৪ সালে তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। (তথ্যসূত্র: https://youtu.be/v7lPgD7mZqs?si=_bkuno_IvDlnYehO)
সুরা নূর, "আলো" নামেও পরিচিত, হযরত মহম্মদের নবী হবার পর পরবর্তী সময়ে মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এ অধ্যায়টি নাযিল (সৃষ্টি হওয়া) হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাথমিক কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হল যে এই সুরাটি নবীর স্ত্রী আয়েশার সঙ্গে জড়িত একটি কেলেঙ্কারির প্রতিক্রিয়া হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। মদিনার কিছু লোক তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ছড়ায়। এই সুরায় এই ধরনের অভিযোগের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়তে হবে এবং কীভাবে সত্য প্রতিষ্ঠা করা যায় তার নির্দেশনা রয়েছে। সুরা নূরের আয়াত নাযিল করে আয়েশার সমস্যার সমাধান করা হয়। এবং আয়েশা নির্দোষ সেটাও প্রতিষ্ঠা করা হয়। মিথ্যা অভিযোগের জবাবে সুরা নূরে বলা হয়েছে-কেউ প্রমাণ ছাড়াই এই ধরনের গুজব ছড়ালে সে গুরুতর পাপে দোষী হবে এবং এই ধরনের অভিযোগ বিশ্বাস করার বা ছড়িয়ে দেওয়ার আগে সত্য প্রতিষ্ঠা করা বিশ্বাসীদের দায়িত্ব। এ ছাড়াও, এ সুরায় সামাজিক ও নৈতিক আচরণের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে শালীনতার গুরুত্ব, ব্যভিচার নিষিদ্ধকরণ, ক্রীতদাসদের সাথে আচরণ এবং সাক্ষ্য ও সাক্ষ্যের নীতিমালা। ইসলামে নারী ও পুরুষদের পর্দার বিধান রয়েছে। ইসলামে নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতের মত পর্দার বিধান খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুরা নূরে বর্ণনা করা হয়েছে- মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি ঈমানদার পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য উত্তম পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ এ ব্যাপারে অবগত। আর ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং যৌনাঙ্গের হেফাজত করে।’ (সুরা নূর : ৩০) পুরুষদের দৃষ্টি সংযত রেখে তাদের পর্দা করার কথা এখানে বলা হয়েছে। নারীদের দৃষ্টি নত করে রাখার সঙ্গে আরোপ করা হয়েছে পোশাকের আবরণ। আতেফেহের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল কেবলমাত্র সে হিজাব খুলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বলে। তিনি বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। তিনি একজন নারী সেই কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অপরদিকে ধর্ষক আলী দারবারীকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ইসলাম ধর্মে কোথাও বলা হয়নি, পর্দা না করলে নারীদের হত্যা করতে হবে। অন্যায় করলে নারী, পুরুষ ভেদে শাস্তির মাপকাঠি ভিন্ন হবে এমন বিধান আরোপিত করা হয়নি । তবে, আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সবার আগে নারীর ভুল দেখতে পেয়ে, তরবারী হাতে ছুটে আসেন!
তালাক
ফোনে তিন তালাক দিয়েছিলেন স্বামী। তার প্রতিবাদ করে থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন স্ত্রী। সেই ‘অপরাধে’, মেয়ের সামনেই তরুণীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ঘটনাটি ঘটেছিল উত্তরপ্রদেশের শ্রাবস্তীতে। ঘটনার নৃশংসতার কথা আঁচ করে শিউরে উঠছিল গোটা দেশ।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছিল, শ্রাবস্তীর বাসিন্দা সাইদাকে ফোনে তিন তালাক দেন তাঁর স্বামী নাফিস। কর্মসূত্রে মুম্বইয়ে থাকতেন তিনি। এর পর ৬ অগস্ট , ২০১৯ সালে এই ঘটনার কথা পুলিশে জানান সাইদা। তিনি লিখিত অভিযোগও করতে চান। কিন্তু, পুলিশ তাঁর অভিযোগ না নিয়ে তাঁকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে। প্রাথমিক ভাবে মিটমাটের চেষ্টা করে পুলিশ। নাফিসকে ডেকেও পাঠানো হয়। ১৫ অগস্ট উত্তরপ্রদেশে নিজের গ্রামের বাড়িতে ফেরে নাফিস। কিন্তু, পুলিশের পরামর্শ মেনে নেননি নাফিস। অভিযোগ, সাইদাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছিলেন তিনি, কিন্তু তাতে রাজি না হওয়ায় নাফিস, তাঁর মা এবং দুই বোন মিলে সাইদার উপর চড়াও হন। এমন ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছে সাইদার পাঁচ বছরের মেয়ের সামনেই। পুলিশের কাছে সে দিনের ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছিল সাইদার মেয়ে। তার বয়ানেই জানা গিয়েছে, সাইদা শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে রাজি না হলে, তাঁকে মারধর করেন নাফিস। সে সময় সাইদার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন নাফিসের দুই বোন। নাফিসের মা দেশলাই জ্বালিয়ে সাইদার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। ((তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ আগস্ট, ২০১৯)
যখন আরবের বিভিন্ন গোত্রর লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে চারপাশ থেকে মদিনায় এসে বাস করতে শুরু করলো তখন মদিনায় একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। সেই সময় সুরা বাকারা সৃষ্টি হয়। এই সুরার মধ্যে দিয়ে সমাজ, সংস্কৃতি, লোকাচার, অর্থনীতি ও আইন সম্পর্কিত মৌলিক বিধান এবং ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে এ নতুন জীবন ব্যবস্থাটি কিভাবে গড়ে তুলতে হবে তারও নির্দেশ দেওয়া আছে। এ সুরার শেষ ২৩টি রুকু’তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্দেশ ও বিধানগুলো বয়ান করা হয়েছে। বাকারা সুরাতে তালাক ও হালালা বিয়ে সম্পর্কিত নির্দেশ দেওয়া আছে।
ইসলামে প্রথমে তালাক না দিয়ে স্বামীকে কিছু পদক্ষেপ নেবার কথা বলা হয়েছে। যদি পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে যায় যে মীমাংসার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়, তখন ইসলামী শরিয়ত স্বামীকে তালাক দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। এর পরও তালাক দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা না থাকলে ইসলামী শরিয়ত সমর্থিত পদ্ধতি অনুসরণ করে তালাক দেবে।
তালাক দেওয়ার পদ্ধতি স্বামী সুস্পষ্ট শব্দে এক তালাক দেবে। এরপর স্বামী যদি স্ত্রীকে ইদ্দত চলা অবস্থায় ফিরিয়ে নেয় তাহলে ভালো। পুনরায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কায়েম হয়ে যাবে। নতুন করে বিবাহের প্রয়োজন হবে না। আর যদি ইদ্দত চলাকালে স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নেয়, তাহলে ইদ্দত (তিন মাস) শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। স্ত্রী স্বামী থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তালাকের পরে উভয়েই অনুতপ্ত হয় এবং বৈবাহিক সম্পর্ক পুনর্বহাল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। যদি ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী এক তালাক দেওয়া হয়, তাহলে এ আশা পূরণের সুযোগ থাকে এবং তারা পুনরায় বৈবাহিক জীবন শুরু করতে পারে। কিন্তু স্বামী একসঙ্গে তিন তালাক দিলে ইদ্দত চলাকালেও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। ইদ্দতের পরেও নতুনভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অবকাশ থাকে না। তারা একে অন্যের জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যায়। এমতাবস্থায় অনুতপ্ত হওয়া এবং আপসের জন্য আগ্রহী হলেও তা কোনো কাজে আসে না। যদি তারা চায় যে আর কোনো দিন তারা একে অন্যের সংসারে ফিরে আসবে না, সে ক্ষেত্রেও ইসলাম একসঙ্গে তিন তালাক দিতে নিষেধ করেছে। প্রতি মাসে এক তালাক করে তিন তালাক দিতে হবে। এভাবে তিন তালাকের মাধ্যমে তারা সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যাবে। এ পদ্ধতিতে তালাক দিলে তালাক-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে স্বাভাবিকভাবে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পাওয়া যায়। নারীদের তালাক দেওয়ার অধিকার নেই। ইসলামে তালাক দেওয়ার অধিকার কেবল স্বামীকেই দেওয়া হয়েছে, স্ত্রীর হাতে তা দেওয়া হয়নি। নারীদের তালাক দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়নি কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, নারীদের স্বভাবে সাধারণত তাড়াহুড়ো করার প্রবণতাটা বেশি। তাই তাদের তালাকের ক্ষমতা দিলে ছোটখাটো বিষয়েও তাড়াহুড়ো করে তালাক দিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা বেশি। সুতরাং অধিক পরিমাণে বিবাহবিচ্ছেদ রোধেই ইসলাম নারীদের তালাকের ক্ষমতা দেয়নি। এখানেও নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। কোন পুরুষ যদি স্ত্রীকে অত্যাচার করে তবুও সেই নারী তালাক দিতে পারবেন না! কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীরা তালাক দিতে পারবেন। নারীরা প্রয়োজনে যথাযথ নিয়মে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারবে। এ জন্য তাদের নির্দিষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ১। বিয়ের আগেই স্ত্রী যদি শর্ত দিয়ে থাকে আমাকে তালাক দেওয়ার অধিকার দিতে হবে, তখন স্বামী অধিকার দিলে স্ত্রী প্রয়োজনে সে অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। ২। যদি বিবাহের সময় শর্ত না দেয়, তাহলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে তালাক নিতে পারবে। ৩। আর যদি তা-ও না করে, তবুও স্বামী নপুংসক হলে, পাগল, অস্বাভাবিক রাগসম্পন্ন হলে বা নিখোঁজ হয়ে গেলে অথবা যেকোনো কঠিন সমস্যায় পড়লে স্ত্রী বিচারকের মাধ্যমে নিজেই তালাক নিয়ে নিতে পারবে।(তথ্যসূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ৫ই ডিসেম্বর, ২০১৭)
অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, সঠিক পদ্ধতিতে তালাক দেওয়া হয় না। আবার, যে নারীটিকে তালাক দেওয়া হচ্ছে, তিনি যদি প্রতিবাদ করেন, তখন পরিস্থিতি সংকটময় হয়ে ওঠে। উপরে সাইদার ঘটনাটি সেই প্রমাণ বহন করে। একসঙ্গে তিন তালাক দিতে ইসলাম ধর্ম নিষেধ করছে। তবুও সেই নিয়ম না মেনেই, বিধানের অপপ্রয়োগ করা হয়ে থাকে!
হালালা বিবাহ
মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ থানার রনজিতপুর গ্রামে হালালা বিয়ের ফতোয়াকে কেন্দ্র করে কয়েক বছর আগে রাজ্য জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। নাসিমা বিবিকে তার স্বামী রবিউল দেড়/দু’ বছর আগে তালাক দিয়েছিল। ওদের দুটি সন্তান তখন বড়টি ছেলে সে নবম শ্রেণিতে পড়ছিল।এবং ছোটটি মেয়ে, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছিল। রবিউল নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্ত্রী নাসিমাকে ফিরিয়ে নেব বলে স্থির করে। সন্তানদের মুখ চেয়ে নাসিমাও সম্মতি দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিবেক, বোধ ও বুদ্ধি সম্পন্ন কিছু মানুষ সালিশি সভায় সিদ্ধান্ত দেয় যে, বিয়ের আগে রবিউলকে তার বাড়ি ও জমির অর্ধেক অংশ নাসিমাকে লিখে দিতে হবে যাতে কথায় কথায় সে আবার তালাক দিতে না পারে, আর যদি দেয়ও তবে যেন নাসিমা ও তার সন্তানদের ভরণ-পোষণের অন্তত কিছুটা সুরাহা হয়। রবিউল তা মেনেও নেয়। এরপর রবিউল ও নাসিমার বিয়ের প্রস্তুতিও শুরু হয়। কিন্তু ভাঙা সংসার জোড়া লাগার আগে মোল্লারা একটি ফতোয়া জারি করেন। তাঁরা জানান, রবিউল ও নাসিমার পুনর্বার বিয়ের আগে নাসিমাকে হালালা বিয়ে করতে হবে। হালালা বিয়ের অর্থ হলো নাসিমাকে আগে অন্য একজন লোককে বিয়ে করতে হবে এবং তার সঙ্গে ন্যূনতম তিন দিন স্বামী-স্ত্রীর মত সংসার যাপন করতে হবে। তারপর ২য় স্বামী নাসিমাকে তালাক দেবার তিন চাঁদ পর নাসিমা রবিউলের সঙ্গে বিয়ের জন্য উপযুক্ত হতে পারবে। এ কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন নাসিমা। তিনি বলেন যে, এমন জঘন্য বিধান তিনি কিছুতেই মানবেন না, তাতে যদি তাঁর প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়ে না হয় না হবে। ফতোয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি সমাজকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, আমি কি পুতুল যে সমাজের লোক আমাকে অন্য পুরুষের হাতে তুলে দেবে এবং সে আমাকে ইচ্ছে মত ভোগ করবে? আমার কি ইজ্জত ও আত্মমর্যাদা বলে কিছু থাকতে নেই? নাসিমা একজন ব্যতিক্রমী মহিলা। এই কুৎসিত ফতোয়ার বিরুদ্ধে তিনি লড়াই চালানোর পণ করবেন বলে স্থির করেছেন। তাই হালালা বিয়ের কুৎসিত ফতোয়াটিকে তীব্র ভাষায় প্রত্যাখান করেই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি। আনন্দ বাজার পত্রিকার মাধ্যমে জঘন্য এই ফতোয়া এবং তার বিরুদ্ধে তাঁর গর্জে ওঠার কথা গোটা দেশেকে জানিয়ে দেন। (তথ্যসূত্র :https://giasuddinonline.blogspot.com/2018/04/?m=1 Wednesday, April 4, 2018)
হালালা বিবাহ একটি নোংরা ও কুৎসিত নিয়ম। নাসিমার ঘটনা থেকে আমরা বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। ইসলাম বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলাম সঠিক ন্যায় বিচার করছে। এই হালালা প্রথার জন্যই পুরুষেরা তালাক দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। নারীটিকে খেলার পুতুল করে অন্য এক পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার মানসিক যন্ত্রণার কথা একবারও ভেবে দেখা হয় না। এ কী রকম শাস্তি! পুরুষের জন্য নারীরা কেন এরকম হেনস্তার শিকার হবেন? আমরা এখন দেখে নেব কোরান কী বলছে হালালা বিবাহ প্রসঙ্গে- কোরআন সুরা বাকারা আয়াত ২৩০ (২:২৩০) বিধান দেওয়া হয়েছে- :, “অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয়, তবে সে তার জন্য বৈধ হবে না, যে পর্যন্ত না অন্য ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহিত হবে। তারপর যদি সে যদি তাকে তালাক দেয়, এবং যদি উভয়ে মনে করে যে, তারা আল্লাহ্র সীমারেখে রক্ষা করতে সমর্থ হবে, তবে তাদের পুনর্মিলনে কারও কোনো অপরাধ হবে না, এবং এটাই আল্লাহ্র সীমারেখা, আল্লাহ্ তা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন। (তথ্যসূত্রঃ ২/২৩০, অনুবাদ – ড: ওসমান গণী)
উত্তরাধিকার আইন
সাবিহা তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। হঠাৎ তার বাবা মারা যান। তখন সে জানতে পারে ইসলাম ফারায়েজ আইন মতে- কোনো নারী যদি একমাত্র সন্তান হন, তবে তিনি কখনো পুরো সম্পত্তির দাবিদার হতে পারেন না! একমাত্র মেয়ে মোট সম্পত্তির অর্ধেক পাবে। সে খোঁজ নিয়ে দেখে যদি তার বোন থাকতো তখন তারা মোট সম্পত্তির দুই–তৃতীয়াংশ পেত। বাকি সম্পত্তি অন্য আত্মীয়রা পাবেন। মৌলবিসাহেব তাকে জানান, কন্যা এবং স্ত্রী পুরো সম্পত্তির দাবিদার হতে পারবে না! সাবিহা মৌলবী সাহেবের থেকে জানতে চাই, পুত্র সন্তান থাকলে কী ভাবে ভাগ করা হতো? তিনি জানান- যদি এক বোন এবং এক ভাই হয় তাহলে একজন ভাইয়ের অংশের অর্ধেক পাবেন একজন বোন। অর্থাৎ যদি কেউ এমতাবস্থায় মারা যায় যে তার এক পুত্র ও এক কন্যা (আর কোনো উত্তরাধিকারী নেই)। তাহলে সমস্ত সম্পত্তি তিন ভাগে ভাগ করে দুই ভাগ পাবে পুত্র আর এক ভাগ পাবে কন্যা। আবার, এক পুত্র ও দুই কন্যা থাকলে সমস্ত সম্পত্তি চার ভাগে ভাগ করে দুই ভাগ পাবেন পুত্র। আর বাকি দুই ভাগ পাবেন দুই কন্যা (প্রত্যেক কন্যা এক ভাগ করে)। সাবিহা এরকম বৈষম্য দেখে চমকে ওঠে! হতাশায় ক্ষোভে সে মনমরা হয়ে ডিপ্রেশনে চলে যায়! যে আত্মীয়দের সে কস্মিনকালেও দেখেনি, তারা অর্ধেক সম্পদ নিয়ে নেবে! একী অদ্ভুত বিচার!
হযরত মহম্মদ যখন আরবে ইসলাম ধর্ম প্রচার করছিলেন তখন নারী ও অনাথরা অবহেলিত ছিল, তাদের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সুরা নিসা অবতীর্ণ হয়। এই সুরার মাঝে নারী বিষয়ক আলোচনা রয়েছে এবং সেই জন্য এই সুরার নাম নিসা রাখা হয়েছে। এই সুরাটি হযরত মহম্মদের কয়েকটি বক্তৃতার সমষ্টি । সম্ভবত তৃতীয় হিজরীর শেষের দিক থেকে নিয়ে চতুর্থ হিজরীর শেষের দিকে অথবা পঞ্চম হিজরীর প্রথম দিকের সময়-কালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন অংশ সৃষ্টি হয়। উত্তরাধিকার বণ্টন ও অনাথদের অধিকার সম্বলিত বিধানসমূহ ওহোদ যুদ্ধের পর সৃষ্টি হয়। তখন সত্তর জন মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনাটির ফলে মদীনার ছোট জনবসতির বিভিন্ন গৃহে শহীদদের সম্পদ কীভাবে বণ্টন করা হবে এবং তারা যেসব ছেলেমেয়ে রেখে গেছেন তাদের স্বার্থ কিভাবে সংরক্ষণ করা হবে, এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এর ভিত্তিতে অনুমান করা হয়েছে, প্রথম তিনটি আয়াত (বাক্য) এ সময় সৃষ্টি হয়েছে।
ইসলামিক ফারায়েজ মতে, নারীর সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রেও বৈষম্য দেখা যায়। বলাই বাহুল্য,পুরুষদের তুলনায় নারীরা কম সম্পদ পেয়ে থাকেন। কোনো নারী যদি একমাত্র সন্তান হন তবে তিনি কখনো পুরো সম্পত্তির দাবিদার হতে পারেন না। সুরা নিসাতে বলা হয়েছে - তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেনঃ পুরুষদের অংশ দু’জন মেয়ের সমান। যদি (মৃতের ওয়ারিস) দু’য়ের বেশি মেয়ে হয়, তাহলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিনভাগের দু’ভাগ তাদের দাও।
আর যদি একটি মেয়ে ওয়ারিস হয়, তাহলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক তার। (সুরা নিসা:১১-১৪)
এই ভাগ নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে -যেহেতু পারিবারিক জীবনের ক্ষেত্রে পুরুষদের ওপর অনেক অর্থনেতিক দায়িত্বের বোঝা বেশি করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেকগুলো অর্থনৈতিক দায়িত্ব থেকে মেয়েদেরকে মুক্তি দিয়েছে, সেইজন্য মেয়েদের অংশ পুরুষদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম রাখা হবে! কন্যা সন্তান হলে কোন অপরাধে সম্পদ আত্মীয়দের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে? চূড়ান্ত অপমানজনক পরিস্থিতিতে নারীদের ফেলেছে, এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ! আজকের দিনে নারী-পুরুষ সকলে সমান তালে কাজ করেন। পারিবারিক অর্থনৈতিক বোঝা সমান ভাবে বহন করেন। তারপরেও এই সকল বিধানে পরিবর্তন আনার জন্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজ আগ্রহী নন।
আমাদের সমগ্র আলোচনায় আমরা দেখতে পেলাম, কীভাবে নারীদের কোণঠাসা করে রেখে, পদে পদে চূড়ান্ত অপমান করা হচ্ছে। একটি পিতৃতান্ত্রিক আইন ধর্মকে ট্রাম্প কার্ড বানিয়ে, চোখ রাঙানিকে সম্বল করে, নারীদের টুঁটি চেপে ধরে, নানাবিধ নোংরামিকে বৈধতার সিলমোহরের ছাপ লাগিয়ে; বহাল তবিয়তে তাদের কার্যসিদ্ধি করে যাচ্ছে। আমাদের আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন, এই সকল আইন-কানুন সমসাময়িক আরবকে কেন্দ্র করে হয়েছিল। এতো বছর পর সেই একই আইন সব দেশের জন্য জুতসই না হতেও পারে, ইসলামিক অনেক দেশে আইনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। আমাদের দেশের মুসলিম পারিবারিক আইনে লিঙ্গবৈষম্য দূর করা প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment